হিজামা কী?
হিজামা হলো একটি প্রাচীন, নিরাপদ ও কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি, যা শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন ও নিস্তেজ রক্ত অপসারণ করে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে। আরবি শব্দ “আল-হাজম” থেকে “হিজামা” শব্দটির উৎপত্তি, যার অর্থ “চোষা” বা “টেনে নেওয়া”। এটি ইংরেজিতে Cupping Therapy নামে পরিচিত এবং আমাদের দেশে “শিঙ্গা লাগানো” নামেও পরিচিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হিজামাকে সর্বোত্তম চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে ঘোষণা করেছেন এবং নিজেও এটি গ্রহণ করেছেন।
হিজামা কিভাবে করা হয়?
হিজামা করার পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ, তবে এটি অবশ্যই একজন দক্ষ থেরাপিস্টের মাধ্যমে করানো উচিত।
- নির্দিষ্ট পয়েন্ট চিহ্নিত করা: শরীরের নির্দিষ্ট অংশে কাপ বসানো হয়।
- ভ্যাকুয়াম তৈরি করা: কাপের মাধ্যমে ভ্যাকুয়াম প্রয়োগ করে রক্ত প্রবাহ সক্রিয় করা হয়।
- চামড়ায় সূক্ষ্ম স্ক্র্যাচ করা: নিস্তেজ রক্ত বের করতে সামান্য কাট দেওয়া হয় (Wet Hijama)।
- রক্ত নিঃসরণ: নেগেটিভ প্রেশারের মাধ্যমে টক্সিনযুক্ত রক্ত বের করে আনা হয়।
- পরিষ্কার ও বিশ্রাম: হিজামার পর সঠিক পরিচর্যা ও বিশ্রামের মাধ্যমে আরোগ্য নিশ্চিত করা হয়।
হিজামার মাধ্যমে শরীরে নাইট্রিক অক্সাইডের উৎপাদন বাড়ে, যা রক্ত সঞ্চালন উন্নত করতে সাহায্য করে।
নববী নির্দেশনার আলোকে হিজামা চিকিৎসা ব্যবস্থা
হিজামা হলো রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সুন্নাহভিত্তিক একটি প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি, যা শরীরের দূষিত রক্ত অপসারণের মাধ্যমে সুস্থতা নিশ্চিত করে। সাহাবায়ে কেরাম হিজামাকে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং অসংখ্য হাদিসে হিজামার উপকারিতা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। আসুন, এক নজরে হিজামার গুরুত্ব সম্পর্কে নববী নির্দেশনা জেনে নেই:
১. হিজামা সর্বোত্তম চিকিৎসা
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
“তোমরা যেসব উপায়ে চিকিৎসা করো, তার মধ্যে সর্বোত্তম হলো হিজামা।”
(সহিহ বুখারী: ৫৬৯৬, সহিহ মুসলিম: ১৫৭৭)
২. হিজামাতে রয়েছে রোগমুক্তির উপায়
হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
“নিশ্চয়ই হিজামাতে রোগের শিফা (আরোগ্য) রয়েছে।”
(সহিহ বুখারী: ৫৬৯৭)
৩. হিজামার মাধ্যমে শরীর মজবুত হয়
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
“হিজামাকারী কতই না উত্তম লোক! সে দূষিত রক্ত বের করে, মেরুদণ্ড শক্তিশালী করে এবং দৃষ্টিশক্তি প্রখর করে।”
(সুনানে তিরমিযী: ২০৫৩, সনদ: হাসান)
৪. হিজামার প্রতি ফেরেশতাদের সুপারিশ
হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
“মেরাজের রাতে ফেরেশতাদের যে দলের সামনে আমি গিয়েছি, তারা সবাই আমাকে বলেছেন: ‘হে মুহাম্মদ (সাঃ), আপনার উম্মতকে হিজামা করার আদেশ দিন।'”
(সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩৪৭৭)
৫. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজে হিজামা করেছেন
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
“আমি মেরুদণ্ড ও কাঁধের মাঝখানে হিজামা করিয়েছি।”
(সহিহ বুখারী: ৫৬৯১)
৬. হিজামার জন্য উপযুক্ত সময় সম্পর্কে নির্দেশনা
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:
“যখন কেউ হিজামা করতে চায়, সে যেন চন্দ্রমাসের ১৭, ১৯ ও ২১ তারিখে তা করে।”
(সুনানে আবু দাউদ: ৩৮৬১)
৭. হিজামার মাধ্যমে সুস্থতা লাভ করা যায়
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি হিজামা করে এবং পরিমিত আহার গ্রহণ করে, সে কোনো রোগে আক্রান্ত হবে না।”
(মুসনাদে আহমাদ: ১১০৭৮)
এসব হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, হিজামা শুধুমাত্র একটি চিকিৎসা পদ্ধতি নয়; বরং এটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সুন্নাহ, যা শরীর ও মনের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাহাবায়ে কেরাম এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে আমল করেছেন এবং বর্তমান সময়েও এটি আধুনিক চিকিৎসার বিকল্প হিসেবে স্বীকৃত।
সুন্নাহ অনুযায়ী স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের জন্য হিজামা করুন এবং সুস্থ থাকুন।
হিজামা গ্রহণের উপযুক্ত বয়স
সাধারণত, কোনো রোগ দেখা দিলেই চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। তবে হিজামা একটি বিশেষ ধরনের চিকিৎসা, যা নির্দিষ্ট বয়সের পর করা বেশি উপকারী। শিশু এবং কিশোরদের ক্ষেত্রে এমন জটিল রোগ কমই দেখা যায়, যা হিজামা করার প্রয়োজন হতে পারে।
ইউনানী বিশেষজ্ঞদের মতে, ১০ বছর থেকে ৬০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা হিজামা গ্রহণের জন্য সর্বাধিক উপযুক্ত। তবে শারীরিক ফিটনেস ভালো থাকলে ৬০ বছরের বেশি বয়সীরাও হিজামা করাতে পারেন, তবে এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উচিত। শারীরিক দুর্বলতা বা কোনো জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে এ বয়সে হিজামা করানো থেকে বিরত থাকাই উত্তম।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শের মাধ্যমে হিজামা গ্রহণ করা আরও নিরাপদ ও কার্যকর হতে পারে।
কেন হিজামা করবেন?
১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে শরীরকে সুস্থ রাখতে।
২. শরীর থেকে ক্ষতিকর পদার্থ ও টক্সিন বের করতে।
৩. অপ্রয়োজনীয় ওষুধের উপর নির্ভরতা কমাতে।
৪. বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে সুস্থ জীবন নিশ্চিত করতে।
৫. সুন্নাহভিত্তিক এই প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতির চর্চা করতে।
6. অসুস্থ ব্যক্তির শারীরিক সুস্থতা দ্রুত ফিরে পেতে।
৭. শিরা ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা উন্নত করতে।
৮. চিকিৎসা শুরু করার আগে দ্রুত উপকার পাওয়ার জন্য।
৯. বদনজর, জিন-যাদু ও নেতিবাচক প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে।
১০. শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সুস্থতা বজায় রাখতে।
১১. স্বাস্থ্যের সামগ্রিক উন্নতির জন্য একটি নিরাপদ ও কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে।
মহিলাদের জন্য হিজামা: ইসলামের দৃষ্টিকোণ
হিজামা একটি সুন্নাহসম্মত চিকিৎসা পদ্ধতি, যা নারীদের জন্যও প্রয়োজনীয় এবং ইসলামসম্মতভাবে অনুমোদিত। শারীরিক সুস্থতা অর্জনের লক্ষ্যে মহিলারা হিজামা গ্রহণ করতে পারেন, তবে শরিয়াহর সীমারেখা মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নারীদের জন্য হিজামা করানোর উত্তম পদ্ধতি হলো, নারী হিজামা থেরাপিস্টের মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ করা অথবা প্রয়োজনে মাহরাম পুরুষের (যেমন স্বামী, বাবা বা ভাই) সহযোগিতা নেওয়া।
যদি কোনো কারণে প্রশিক্ষিত মহিলা হিজামাকারী পাওয়া না যায়, তবে ইসলামি বিধানের আলোকে করণীয় হলো—একজন অভিজ্ঞ পুরুষ হিজামাকারী তার মাহরাম নারীদের (যেমন স্ত্রী বা বোন) এই চিকিৎসা পদ্ধতি শেখাবেন, যাতে তারা অন্যান্য নারীদের হিজামা করাতে পারেন।
বিশেষ পরিস্থিতিতে করণীয়:
কখনো কখনো এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, যেখানে শুধুমাত্র হিজামাই রোগ নিরাময়ের একমাত্র উপায় এবং কোনো নারী থেরাপিস্ট বা মাহরাম পুরুষের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, তা নির্ধারণের জন্য অভিজ্ঞ আলেম বা মুফতির পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
তবে, কোনো অবস্থাতেই একজন নারী গায়রে মাহরাম পুরুষের মাধ্যমে হিজামা করাবেন না, এবং তদ্রূপ, কোনো নারী গায়রে মাহরাম পুরুষকে হিজামা করানোও শরিয়াহসম্মত নয়।
পর্দা ও শালীনতা বজায় রেখে হিজামা করান এবং সুন্নাহর এই গুরুত্বপূর্ণ আমলকে জীবনের অংশ করুন।
হিজামার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: কতটা নিরাপদ?
সঠিক নিয়ম মেনে এবং স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে হিজামা করলে সাধারণত কোনো গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। হিজামা একটি নিরাপদ ও প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি, কারণ এতে শরীরে কোনো রাসায়নিক পদার্থ প্রবেশ করানো হয় না এবং সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে শরীরের নিস্তেজ রক্ত অপসারণ করা হয়।
তবে, কিছু স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যেমন:
- ত্বকে লালচে দাগ: কাপিংয়ের ফলে চামড়ার উপরে সাময়িক লালচে দাগ বা রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার অনুভূতি দেখা দিতে পারে, যা সাধারণত ৩-৭ দিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যায়।
- ফোস্কা পড়া: যদি কাপের চাপে অতিরিক্ত নেগেটিভ প্রেসার তৈরি হয়, তাহলে সামান্য ফোস্কা পড়তে পারে। এ ধরনের সমস্যা এড়াতে হিজামার পদ্ধতি সঠিকভাবে অনুসরণ করা প্রয়োজন।
- হালকা মাথা ঘোরা: প্রথমবার হিজামা করার পর কিছু মানুষের মধ্যে সামান্য দুর্বলতা বা মাথা ঘোরার অনুভূতি হতে পারে, যা বিশ্রামের মাধ্যমে দ্রুত সেরে যায়।
সতর্কতা:
- হিজামা করার সময় অ্যান্টিসেপ্টিক ব্যবস্থা মেনে চলা জরুরি, যাতে কোনো ধরনের সংক্রমণ এড়ানো যায়।
- যদি ফোস্কা পড়ে, তাহলে উক্ত স্থানে পুনরায় কাট না দেওয়া উত্তম।
- যাদের ত্বক খুব সংবেদনশীল, তাদের জন্য হিজামার সময় অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
অনেকেই মনে করেন, হিজামা একটি ভীতিকর প্রক্রিয়া, কারণ এতে রক্ত বের হয়। তবে বাস্তবে এটি একেবারেই ব্যথাহীন এবং নিরাপদ, বরং এটি রোগমুক্তির একটি সহজ ও কার্যকর উপায়। হিজামার সময় সামান্য অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে, তবে এটি কোনোভাবেই ভয় পাওয়ার মতো কিছু নয়; বরং এটি শরীরের সুস্থতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
সঠিক নিয়ম অনুসরণ করে এবং প্রশিক্ষিত থেরাপিস্টের মাধ্যমে হিজামা করান, সুস্থ থাকুন।
হিজামা সম্পর্কিত সাধারণ জিজ্ঞাসা
হিজামায় কি ব্যথা লাগে?
হ্যাঁ, তবে ব্যথার মাত্রা খুবই সামান্য। একে প্রকৃত ব্যথা বলা যায় না, বরং হালকা অস্বস্তি বা চাপ অনুভূত হয়, যা সহজেই সহ্য করা যায়।
হিজামা করতে কত সময় লাগে?
সাধারণত ৪০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। তবে রোগের ধরন এবং ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে কিছু ক্ষেত্রে সময় একটু বেশি লাগতে পারে।
হিজামার দাগ কতদিনে চলে যায়?
হিজামার পর ত্বকের স্বাভাবিক রঙ ৩-৭ দিনের মধ্যে ফিরে আসে। সম্পূর্ণভাবে দাগ মিলিয়ে যেতে ১৫-২০ দিন সময় লাগতে পারে।
মুখে হিজামা করলে কি দাগ চলে যায়?
৯৯% ক্ষেত্রে মুখের হিজামার দাগ পুরোপুরি চলে যায় এবং ত্বক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
হিজামার জন্য কয়টি সেশন প্রয়োজন?
সাধারণত যেকোনো ব্যথার জন্য অন্তত ৩টি সেশন নেওয়া হয়। তবে রোগের ধরন ও উপশমের উপর ভিত্তি করে সেশনের সংখ্যা কমবেশি হতে পারে।
আপনাদের সেন্টারে কিভাবে আসবো?
আমাদের সেন্টারে আসার জন্য লিফলেটে দেওয়া নম্বরে কল করুন এবং বিস্তারিত ঠিকানা জেনে নিন।
হিজামার মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন যেসব রোগীরা:
হিজামা চিকিৎসায় উপকার পেয়েছেন এমন কিছু সমস্যার তালিকা:
- মাথাব্যথা ও মাইগ্রেন।
- ঘাড় ও পিঠের ব্যথা।
- টেনশনজনিত ব্যথা।
- উচ্চ রক্তচাপ।
- কোমর ব্যথা ও সায়াটিকা।
- হাঁটু ও গোড়ালির ব্যথা।
- এলার্জি সংক্রান্ত সমস্যা।
- বদনজর, জাদু ও মানসিক চাপজনিত সমস্যা।
বিশেষ পরামর্শ:
আপনার যদি কোনো নির্দিষ্ট শারীরিক সমস্যা বা ব্যথা থাকে, তাহলে অভিজ্ঞ হিজামা থেরাপিস্টের পরামর্শ নিয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করুন।